সূচনা
ঐতিহাসিকদের এ বিষয়ে দ্বিমত নেই যে, এই বাংলা বদ্বীপ একসময় ছিল বঙ্গ, সমতট এবং পুন্ড্র রাজ্যের অংশ। এছাড়া, সহস্রাব্দের জন্য এ অঞ্চল মৌর্য (৩২১ থেকে ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যেরও (৩১৯ থেকে ৫৪৩ খ্রিস্টাব্দ) অংশীদার ছিল। পাল (৭৫০ থেকে ১১৬১ খ্রিস্টাব্দ) এবং সেন রাজারাও (১০৭০ থেকে ১২৩০ খ্রিস্টাব্দ) বাংলা অঞ্চল শাসন করেছিলেন। পরবর্তীতে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এসে সুলতানগণ এ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নেয় তার আগ পর্যন্ত এ বদ্বীপ হিন্দু রাজা এবং বারো ভূঁইয়ার মতো জমিদারদের দ্বারা শাসিত হতো। ১৯৪৭ সালে সমগ্র বাংলা বদ্বীপ বা বৃহত্তর বাংলাকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা হয় পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ নামে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংসদে বঙ্গবন্ধুর তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও এ অঞ্চলকে পূর্ব বাংলা থেকে পূর্ব পাকিস্তান নামকরণ করা হয়। ১৯৭১ সালে এসে সে অঞ্চলই এক মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গৌরবোজ্জ্বল বিজয় অর্জন করে। ঐতিহাসিকভাবে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর আগে আর কোনো রাজা/রাণী, সুলতান বা শাসক বর্তমান বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে শাসন করেননি। এছাড়া, তাদের কেউই রক্ত, জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি এবং জন্মগত দিক থেকে বঙ্গবন্ধুর মতো খাঁটি বাঙালি ছিলেন না।
দিনটি ছিল ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ এবং গুগল ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বুধবার। তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায় ওইদিন জন্ম হয়েছিল এক শিশুর। তবে তা কিন্তু সাধারণ কোনো মানুষের জন্ম ছিল না। বরং এ ছিল এক বীরের জন্ম, যাঁর বীরত্বপূর্ণ ঘটনাবলী সমসাময়িক ইতিহাসে দুর্লভ ও অতুলনীয়। একইসঙ্গে এটি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-কৌশলগত নাটকীয় পরিবর্তন আনার দিনও। কারণ, জন্মের অর্ধশত বছর পরেই 'খোকা' নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠা এই শিশুই নিজ ব্যক্তিত্বের জন্য হয়ে উঠবেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়। একইসঙ্গে যার কণ্ঠে স্বাধীনতার আহ্বান প্রতিধ্বনিত হবে পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে। তিনিই সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে স্বাধীনতার প্রশ্নে একত্রিত হতে অনুপ্রাণিত করবেন। তার কারিশমা, প্রতিভা এবং প্রজ্ঞা এমন একটি নতুন জাতিরাষ্ট্র, মুদ্রা, মানচিত্র এবং পতাকার জন্ম দিয়েছিল যাকে আমরা আজ খুব ভালোবেসে বলি বাংলাদেশ। সেই শিশু, সেই খোকা আর কেউ নন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বিখ্যাত জার্মান মনস্তাত্ত্বিক ডিয়েট্রিচ ডর্নার তার দ্য লজিক অব ফেইলর বইয়ে উল্লেখ করেন, মেধাবীরা যখন জন্মগ্রহণ করেন, জ্ঞানীরা তাদের প্রজ্ঞার মাধ্যমে জটিল পরিস্থিতি ঠিকই অনুধাবন করতে পারেন। ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, কোনো দরিদ্র এবং নিরক্ষর জাতির জন্য তাদের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী শাসক বা নিপীড়ককে পরাজিত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার মতো জটিল পরিস্থিতি আর হতে পারে না। অথচ প্রতিভা ও প্রজ্ঞার সংমিশ্রণে মাত্র নয় মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু তাঁর কৌশলগত নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন। ৭ মার্চের তেজোদীপ্ত ভাষণ দিয়ে লাখ লাখ বাঙালির হৃদয় ও মনে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন। সে ভাষণে স্বাধীনতার জন্য তাঁর উদাত্ত আহ্বান বাঙালির মনকে আন্দোলিত করেছিল। তাই তো একটি বিজয়ী জাতি হিসেবে আবির্ভূত হতে বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান বা কৌশলগত নির্দেশনা তারা খুব সহজে আন্তরিকতার সাথে পড়তে পেরেছিল।
এই রচনার উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তাত্ত্বিকভিত্তিক রিয়ালিযম এর নিরিখে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সফল 'রাজনীতির কবি', 'দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক' বঙ্গবন্ধুর কৌশলগত ও অতি বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিশ্লেষণ করা।
রাষ্ট্রনায়কত্ব ও রিয়ালিযমের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু
রিয়ালিযম বা কারো কারো মতে পলিটিক্যাল রিয়ালিযম আন্তর্জাতিক রাজনীতির এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যা তার প্রতিযোগিতামূলক এবং বিতর্কিত চরিত্রের উপর জোর দেয়। বাস্তববাদীরা (রিয়ালিষ্ট) মনে করেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের মূল চরিত্র রাজ্য বা ভূখন্ড। মূলত নেশন স্টেট্স প্রাথমিকভাবে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তার উপর তারা নিজেদের জাতীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য কাজ করে। এমনকি জাতিগুলোর মধ্যে ক্ষমতা, প্রভাব এবং মর্যাদা অর্জনের অভীষ্ট লক্ষ্য নিয়ে দেশসমূহ পরিচালিত হয়। আর পলিটিক্যাল রিয়ালিস্টগণ মনে করেন, জাতীয় রাজনীতি কর্তৃত্ব এবং আইনকে নিজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি কখনো কখনো নৈরাজ্য এবং অন্যায়ের এমন এক ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়, যখন একে সক্রিয় বা সম্ভাব্য দ্বন্দ্ব দ্বারা চিহ্নিত করা যায়।
এই রাজনৈতিক বাস্তববাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে থুসাইডিডেস (৪৬০-৪০০ খ্রী.পূর্ব), ম্যাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭ খ্রীস্টাব্দ) এবং থমাস হবস (১৫৮৮-১৬৭৯ খ্রীস্টাব্দ) সবচেয়ে বিখ্যাত। যদিও বাস্তববাদের প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে সমালোচনা আছে। তবুও বিংশ শতাব্দীর ধ্রুপদী বাস্তববাদ বর্তমানে বেশিরভাগই নব্য বাস্তববাদিতা দ্বারা প্রতিস্থাপিত। আবার শাস্ত্রীয় এবং নব্য বাস্তবতাবাদ উভয় নিয়েই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা সমালোচনা করেছেন। এমনকি উত্তর-আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এর সমালোচনা করা হয়। এক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর তাত্ত্বিক রেইনহোল্ড নিবুর (১৮৯২-১৯৭১) এবং হান্স মরগেনথাউ (১৯০৪-১৯৮০) বনাম মৌলবাদী বা চরম বাস্তববাদের মধ্যে পার্থক্য আঁকা যেতে পারে। এটা সত্য যে, ধ্রুপদী বাস্তববাদ জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে সমর্থন করে। কিন্তু এটি ম্যাকিয়াভেলির সেই মতবাদকে সমর্থন করে না, যেখানে বলা হয়েছে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যে কোনো কিছু করাই যুক্তিপূর্ণ। বরং ধ্রুপদী বাস্তববাদীরা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নৈতিক রায়কেই সমর্থন করেন। যদিও তারা তথাকথিত নৈতিকতাবাদীদের যারা নিজেদের উন্নতির সমালোচনাকারী কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বা রিয়াল পলিটিক (Real Politik) কে গ্রহণ করে না তাদের ব্যাপারে ভ্রু কুচকান।
সাধারণ জনগণ একজন রাষ্ট্রনায়কের সংজ্ঞা জানতে চায়। একইসঙ্গে তারা জানতে চায় একজন রাষ্ট্রনায়ক ও একজন রাজনীতিবিদের মধ্যে পার্থক্য কী? বিভিন্ন সাহিত্যে বা শব্দকোষে এর সংজ্ঞা নিয়ে কম বেশি আলোচনা হয়েছে। কেমব্রিজ ইংলিশ ডিকশনারিতে 'রাষ্ট্রনায়ক' শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে “একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে, বিশেষ করে যিনি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও গ্রহণযোগ্য”। এ থেকে সাধারণভাবে বোঝা যায়, রাষ্ট্রনায়ক একজন রাজনীতিবিদের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। রাজনীতিবিদ এমন একজন ব্যক্তি, যিনি ভোটে নির্বাচিত হওয়ার জন্য জনগণকে কিছু প্রতিশ্রুতি দেন। অপরদিকে, একজন রাষ্ট্রনায়ক এমন ব্যক্তিত্ব, যিনি তাঁর জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী এবং তাদের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য প্রচেষ্টা করেন। ঐতিহাসিকরা বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ হিসেবে স্যার উইনস্টন লিওনার্ড স্পেন্সার চার্চিলকে (১৮৭৪ ১৯৬৫) গণ্য করেন। কারণ, তিনি এমন একজন পরিবর্তন প্রত্যাশী নেতা এবং রাজনীতিক ব্যক্তি ছিলেন, যিনি তাঁর অনন্য কৌশলগত অন্তর্দৃষ্টি, আবেগ এবং ব্যক্তিত্ব দিয়ে দেশের ক্রান্তিকালে মানুষকে অনুপ্রাণিত করার মহান ক্ষমতা প্রদর্শন করেছিলেন।
নিঃসন্দেহে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক হলেন 'রাজনীতির কবি', 'দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক', সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, 'জাতীয় মহানায়ক', জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত জার্নাল নিউজউইক তাদের ১৯৭১ সালের এপ্রিল সংখ্যা বঙ্গবন্ধুকে 'রাজনীতির কবি' হিসেবে আখ্যায়িত করে। বঙ্গবন্ধু এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যে সময়টি ছিল দুর্দান্ত। কারণ, তাঁর ছিল নেপোলিয়ানের মতো Coup d'oeil বা দূরদৃষ্টি, আব্রাহাম লিংকনের মতো দুর্লভ নেতৃত্বের গুণাবলী, যা শুধুমাত্র একজন অতুলনীয় রাষ্ট্রনায়কের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হতে পারে। বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দিয়েছিলেন, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ অসাধারণ প্রাণবন্ত কণ্ঠে দেওয়া তাঁর সেই ভাষণ জনগণকে আকর্ষণ করেছিল চুম্বকের মতো। তাঁর সেই নাটকীয় অথচ অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক ভাষণ মানুষকে স্বদেশের মুক্তির মতো একটি মহৎ উদ্দেশ্যে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে বাধ্য করেছিল। স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন অলিম্পিয়ান ব্যক্তিত্ব। এজন্য তাঁর মধ্যেই একত্রে সন্নিবেশ ঘটেছিল জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৩২-১৭৯৯), আব্রাহাম লিংকন (১৮০৯-১৮৬৫), চার্চিল বা লি কুয়ান ইউদের (১৯২৩-২০১৫) সামষ্টিক গুণাবলী। তিনি ছিলেন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার চাপানো নব্য ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর এমন এক সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিলো, যার লক্ষ্য ছিল: SMART [Specific, Measurable, Achievable, Realistic and Time-bound (সুনির্দিষ্ট, পরিমাপ ও অর্জনযোগ্য, বাস্তবসম্মত এবং সময়সীমাযুক্ত)]। যার মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ ও স্বাধীনতার সুফল নিশ্চিত করা যায়।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর থেকে বাস্তববাদকে সবচেয়ে প্রভাবশালী তত্ত্ব হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এ বাস্তববাদীরা মনে করেন, নেশন স্টেট্স মূলত নিরাপত্তার জন্য নৈতিকতার চেয়ে সামরিক ও অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষার দ্বারা অধিক অনুপ্রাণিত। আর এ মতবাদের প্রধান প্রবর্তক ছিলেন ই. এইচ. কার, জর্জ এফ, কেনান, হ্যানস জে. মরগেনথাউ, রাইনহোল্ড নিবুর এবং কেনেথ ডব্লিউ. থম্পসন। আবার বিপরীতভাবে, নব্য বা কাঠামোগত বাস্তববাদীরা (Structural Realists) যুক্তি দেন যে, রাষ্ট্রীয় নেতারা ক্ষমতার জন্য তাদের সহজাত আকাঙ্ক্ষার দ্বারা পরিচালিত নন। বরং তারা প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাঠামো থেকেই শক্তি বা ক্ষমতা অর্জন করতে চান। তারা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার এমন নৈরাজ্যপূর্ণ চরিত্রকে চিহ্নিত করেন, যেখানে রাষ্ট্রগুলোকে টিকে থাকার জন্য নিরন্তর সচেষ্ট হতে হয়। তাই রানা ম্যাকমিলানকে উদ্ধৃত করে বলেন, যে তিনটি 'এস' বাস্তববাদী ত্রিভুজের তিনটি কোণকে প্রতিনিধিত্ব করে, তা হলো 'স্ট্যাটিজম' বা পরিসংখ্যান, 'সারভাইবাল' বা বেঁচে থাকা এবং 'সেলফ হেলপ' বা স্বনির্ভরতা। অতএব, বলাই যায় যে, বাস্তববাদী কাঠামোর ভিত্তি হলো 'রাষ্ট্র'। এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্র এবং এর নিরাপত্তা ছাড়া অন্যান্য সব বিষয়কে কম প্রাধিকার দেওয়া হয়। আর এমন মুহূর্তেই সুস্পষ্ট প্রশ্ন ওঠে যে, 'বাস্তবতাবাদ' বা বাস্তবতাবাদি রাজনীতি' শব্দটি বঙ্গবন্ধু ছাড়া প্রকৃত অর্থে আর কে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন? তিনি ছাড়া আর কে বুঝেছিলেন যে, বাঙালি জাতির একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রয়োজন? এভাবেই আগ্রহী পাঠক একজন মহান রাষ্ট্রনায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ভূ-রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রতিফলন দেখে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হতে পারেন।
ব্রিটিশ ইন্ডিপেনডেন্ট লেবার পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফেনার ব্রকওয়ে যথাযথই বলেছিলেন, “এক অর্থে শেখ মুজিব ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী এবং ডি ভ্যালেরার চেয়ে বড় নেতা”।" আবার জেমস নোভাক বলেছেন, “শেখ মুজিব রাজনৈতিক পরিবেশে তাৎক্ষণিকতা এনেছিলেন। তিনি চালাকি চাতুরতা বা আধাআধি কোনো ব্যবস্থা দ্বারা মানুষকে ধোঁকা দেননি। সরকারি অফিস বা ক্ষমতার প্রতি তার কোনো লোভ ছিল না"। নোভাকের কাছে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির প্রকাশ ঘটেছিল অন্যভাবে। তিনি মনে করেন, “কঠিন কাজই ছিল শেখ মুজিবের স্টাইল। তিনি একদিকে গ্রাম থেকে গ্রামে মাঠে মাঠে হেঁটেছেন এবং মানুষের সাথে মিশেছেন, তাদের চাল, ডাল এবং লবণ ভাগ করে নিয়েছেন, তাদের স্বজনদের নাম স্মরণ করেছেন, মসজিদে নামাজ পড়েছেন, মাঠে ঘেমেছেন, বন্যা কবলিত জায়গা পরিদর্শন করেছেন, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং মিলাদে কেঁদেছেন। মানুষের ঘামে ভেজা হাত ছুঁয়েছেন। কারণ, তিনি জানতেন, লোকেরা বিশ্বাস করে, যে জিনিসগুলো তারা বোঝে না, সেগুলো তিনিই কেবল তাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারেন। আর জনগণ তাঁর এ ক্ষমতাকে সম্মান করতো। সেজন্য জনগণ বিশ্বাস করেছিল যে, বঙ্গবন্ধুর মিথ্যা বলার দরকার নেই”।
রাষ্ট্রনায়কের চার গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলী বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনায়কত্ব বিশ্লেষণ
১৬৪৮ সালে ওয়েস্টফালিয়ান সিস্টেম নামে একটি নীতি প্রবর্তিত হয়। যে নীতিতে বলা হয়েছে, প্রতিটি রাষ্ট্রের তার ভূখন্ড এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সার্বভৌমত্ব রয়েছে। এছাড়া, কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। তা সে যে আকারের রাষ্ট্রই হোক না কেন আন্তর্জাতিক আইন তার জন্যও সমান।” উত্তর-পশ্চিম জার্মানির ওয়েস্টফালিয়ার শান্তি চুক্তির ওই অঞ্চলের ত্রিশ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটে। ওয়েস্টফালিয়ান মডেলের বেশিরভাগ জাতিরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তাঁদের প্রেসিডেন্ট বা সরকারপ্রধান নির্বাচন হুবহু এক না হলেও প্রায় একই রকম। এ নির্বাচন প্রক্রিয়ার সময় সাংবাদিক, চিন্তাবিদ এবং বিশ্লেষকরা প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের পূর্ব ইতিহাস, বক্তৃতা, ব্যক্তিত্ব, নির্বাচনী ইশতেহারসহ সব কিছুর আনুবীক্ষণিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা যাচাই বাছাই করেন। প্রক্রিয়াটি কোনো না কোনোভাবে ভোটারদের মানসিকতাকেও মূল্যায়ন বা বিনির্মাণ করে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যিনি নেতা হবেন তার কিছু অপরিহার্য গুণাবলী থাকার প্রয়োজনীয়তা। সুতরাং, প্রার্থীদের মূল্যায়ন এবং বিচারের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য মানদন্ড নির্ধারণ করা হয়। এমনকি যারা ইতোমধ্যে উচ্চ পদে আসীন রয়েছেন তাদের কাছেও এ প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য। আমরা জানি যে, প্রার্থী শনাক্তকরণে ও পরবর্তীতে নির্বাচনের মানদন্ডে জনমত ভিন্ন হবে। তাই এ ক্ষেত্রে সঠিক মানদন্ড নির্ধারণে যেখানে তিনি বলেছেন একজন রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রনায়ক সমান নন। ব্রেট এবং কেট ম্যাকে এর মতে একজন রাষ্ট্রনায়ক অত্যাচারী নন। বরং তিনি হবেন মুক্ত মানুষের মুক্ত নেতা। তবে তাকে “চারটি গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে" যেমন:
১. প্রখর নীতিবান।
২. নৈতিক মাত্রাবোধ।
৩. রূপকল্প বা দূরদৃষ্টি।
৪. রূপকল্প অর্জনের জন্য মানুষকে একত্রিত করার অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা।
একবার কেউ যদি গণতন্ত্রপন্থী একজন রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার চারটি মানদন্ড অপেক্ষাকৃত গভীরভাবে খেয়াল করে, তাহলে বুঝতে অসুবিধা হবে না যে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে এসব গুণাবলীর সবকটিই বিদ্যমান ছিল। শুধু এ চারটিই নয়, একইসঙ্গে অন্যান্য বিশিষ্ট গুণাবলী বঙ্গবন্ধুকে করে তুলেছে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক। সংক্ষেপে এ গুণাবলীর উপর নিম্নে আলোচনা করা হলো:
প্রখর নীতিবান
শক্ত নৈতিক ভিত্তি একজন রাজনীতিকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে তিনি তার প্ল্যাটফর্মকে দৃঢ়, অবিচল এবং মৌলিক সত্যের ভিত্তিতে তৈরি করেন। এ জিনিসগুলো তিনি কর্ম ও হৃদয় দ্বারা যেমন বিশ্বাস করেন, তেমনি গ্রহণ করেন অপরিহার্য দর্শন হিসেবে। যাকে একটি ভবনের ভিত্তির সঙ্গে তুলনা করা যায়। যেখানে ঘূর্ণিঝড় বা ভূমিকম্প ভবনের কাঠামোকে ধাক্কা দিতে পারে, কিন্তু তার ভিত্তি শক্ত হলে সেটি কখনোই হেলে পড়বে না। একজন অভিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কও সবসময় স্থান ও পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে নীতি বা কৌশল সহজে নির্ধারণ করতে পারেন। এমনকি লক্ষ্য অর্জনের পদ্ধতিগুলোও পরিবর্তনের ক্ষমতা তার আছে। তবে স্বল্পমেয়াদী কৌশল শুধুমাত্র তার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্য হিসেবে কাজ করে। জাতির পিতার এমন সব অসাধারণ কৌশলের ইতিহাস তার সমস্ত কথোপকথনে কর্মজীবনে রেকর্ড করা আছে। এছাড়া, দেশের জনগণ যেন নিপীড়ন এবং অবিচার থেকে মুক্তি পায় সেজন্য তৎকালীন পাকিস্তানি নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকেও তাঁর অবস্থানের দৃঢ় প্রতিফলন ছিল।
নৈতিক মাত্রাবোধ
ড. ফিয়ার্স আধুনিক রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে একটি বিশেষ উদাহরণ প্রদান করেন। তিনি বলেন, আধুনিক রাজনীতিবিদরা 'অ্যান্টেনা' নামে একটি বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ড. ফিয়ার্স যুক্তি দেন যে, জনগণের মেজাজ ও তাদের ভোেট হারাবেন কিনা তা বোঝার জন্য রাজনীতিবিদরা কোন দিকে হাওয়া বইছে তা পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করেন। তারপর জনমত বুঝে তিনি সেদিকে তার পাল তোলেন। কিন্তু একজন রাষ্ট্রনায়ক এমনতর জনমত দ্বারা পরিচালিত হন না। বরং একজন প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক তাঁর নিজের নৈতিক কম্পাসের নির্দেশনা অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর নৈতিক মাত্রার বর্ণচ্ছটা হয় গভীর ও নিখুঁতভাবে সঠিক হবে, নয়তো তা যাবে চরম ভুলের রাজ্যে। ক্ষমতার সামনেও তিনি সাহসী এবং সত্য কথা বলতে হবেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যদি তিনি কিছু ভুল দেখেন, তাহলে দৃঢ়চিত্তে সামনে এসে বলবেন এটি ভুল। সেইসঙ্গে ওই ভুলের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও তিনি পিছিয়ে থাকেন না। আবার যখন নিশ্চিত হন যে এটি সঠিক, তখন একে রক্ষার জন্য যেমন দৃঢ় অবস্থান নেন, তেমনি এর স্বার্থে যে কোনো কষ্ট সইতেও প্রস্তুত থাকেন। সবমিলিয়ে একজন রাষ্ট্রনায়ককে অবশ্যই উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে হবে। স্বপ্ন রূপকল্প বাস্তবায়নের জন্য তাকে অবশ্যই একটি ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। একইসঙ্গে তাকে অবশ্যই হতে হবে সৎ। তিনি দেশবাসীকে তাদের সর্বোত্তম কল্যাণ ও প্রাপ্তির প্রতিনিধিত্ব করার জন্য অহিংস পদ্ধতিতে নৈতিক কর্তৃত্বের দ্বারা নেতৃত্ব দেবেন। এখন যদি আমরা বঙ্গবন্ধুর জীবনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই যে মন্দ কাজের বিরুদ্ধে দৃঢ় নৈতিক অবস্থানের কারণে তাকে প্রায়শ কারাবরণ করতে হয়েছে। তিনি তার জীবনের মূল্যবান পঞ্চান্ন বছরের প্রায় এক চতুর্থাংশ এবং পাকিস্তানি শাসনামলের প্রায় অর্ধেক কারাগারে কাটিয়েছেন।
'রূপকল্প' বা 'দূরদৃষ্টি'
লেখক 'রূপকল্প' বা 'দূরদৃষ্টি'-কে একটি ব্রাকেটে আবদ্ধ করে লিখেছেন, যাতে বঙ্গবন্ধুর ভিশনের উপর গুরুত্বারোপ করা যায়। তাঁর স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়া। যা অনেকটা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের অপূর্ণ স্বপ্নের মতো। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামের ভাষায়, “স্বপ্ন তা নয় যা আপনি ঘুমানোর সময় দেখেন। বরং স্বপ্ন হলো এমন কিছু যা আপনাকে ঘুমাতে দেয় না"। সুতরাং বলা যায় যে, একজন সফল রাষ্ট্রনায়কের অবশ্যই তার দেশ ও মানুষের ভবিষ্যত সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন দিব্যদৃষ্টি থাকতে হবে। ড. ফিয়ার্স মনে করেন যে, একজন রাষ্ট্রনায়কের অন্তর্দৃষ্টি (Coup d'oeil) তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। তিনি অবশ্যই জানবেন জনগণ ও দেশকে তিনি কোনদিকে নিতে চান। অবশ্যই তাঁর কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। এতে একদিকে যেমন ওই রাষ্ট্রনায়ক আসন্ন চ্যালেঞ্জগুলো চিনতে সক্ষম হবেন, অন্যদিকে এর কার্যকর সমাধানগুলোও সফলে প্রয়োগ করতে পারবেন। আর এ সমাধান শুধু ভালোই হবে না, একইসঙ্গে হবে টেকসই। তাই একজন রাষ্ট্রনায়ক কেবল বর্তমান নিয়েই সন্তুষ্ট হবেন না, তিনি ভবিষ্যত সম্পর্কেও থাকবেন আশাবাদী, উদ্বিগ্ন ও সচেতন। এছাড়া ভবিষ্যতে তাঁর দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বা পররাষ্ট্র নীতিকে প্রভাবিত করার জন্য বিশ্ব কীভাবে উদ্ভূত হবে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য স্ট্র্যাটেজিক দিকনির্দেশনা দেবার যোগ্যতা একজন রাষ্ট্রনায়কের থাকা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সমালোচকদেরও একমত হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই যে, শেখ মুজিব শুধু একজন প্রতিভাধর রাজনীতিক বা কেবল একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্নই দেখেছিলেন এমন নয়, বরং খুব অল্প সময়ের মধ্যে সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নও করছিলেন। কূটনীতি থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, পররাষ্ট্র থেকে অর্থনৈতিক নীতি, সামরিক থেকে রাজনৈতিক বা পরিবেশগত কিংবা আইনি ক্ষেত্র, এমন কোনো ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে এই দূরদর্শী নেতা অন্ধকারে আলোর দিশারী হিসেবে তার নির্দেশনা দিয়ে যাননি।
লক্ষ্য অর্জনে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা
যৌক্তিকভাবেই একজন রাজনীতিবিদের দৃঢ় নৈতিক ভিত্তির পাশাপাশি, মাত্রাবোধ এবং একটি ভিশন রূপকল্প বা স্বপ্ন থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সে লক্ষ্য পূরণে যদি তাঁর জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষমতা না থাকে তাহলে সমস্ত প্রচেষ্টা সম্ভবত নিরর্থক হয়ে পড়বে।
একজন রাষ্ট্রনায়ককে অবশ্যই এমন লোকদের বেছে নিতে হয় যারা তাঁর লক্ষ্যকে বাস্তবায়নে সরকারে কাজ করবে। এছাড়া, একজন সফল রাষ্ট্রনায়কের আসল সাফল্য হলো তার চারপাশের মানুষ এবং সমগ্র জাতিকে নিজের দর্শনের ন্যায়পরায়ণতা দিয়ে তাদের মন জয় করতে বোঝানোর ক্ষমতা। তাই রাষ্ট্রনায়ককে অবশ্যই একজন দক্ষ বক্তা হতে হবে। আর বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের জীবনী, তাঁদের লেখা বই এবং ইতিহাস বিষয়ে দীর্ঘস্থায়ী পাঠই তাকে মানুষকে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর মতো প্রজ্ঞাবান করে তোলে। এছাড়া, একজন সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জনমতের উপর ভরসা না রেখে নিজের নৈতিক কম্পাসকেই অনুসরণ করেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, যখন জনগণের আদর্শকে অনৈতিকভাবে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হবে, তখন শক্তিশালী নৈতিক বক্তব্যের মাধ্যমেই তাদের আবার সক্রিয় করে তোলা যায়। আর রাষ্ট্রনায়কের বক্তব্যের শক্তি আসে সেই সত্য থেকে, যা আসলে তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন। যদিও অনেকে বলতে পারেন যে, যেসব গুণাবলীর কথা বলা হয়েছে সেগুলো আজগুবি বা বান্তবসম্মত নয়। আর এসব গুণাবলী কখনো একজন একক নেতার মধ্যে সন্নিবেশিত হবে না। কিন্তু এ চারটি গুণের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর মধ্যে তা খুব স্পষ্টভাবেই সন্নিবেশিত ছিল।
ড. ফিয়ার্স বিশ্বাস করতেন যে, ইতিহাসের তিনজন সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক হলেন এথেন্সের পেরিক্লেস (৪৯৫-৪২৯ খ্রি.পূর্ব), আব্রাহাম লিঙ্কন এবং উইনস্টন চার্চিল। কারণ, তাঁদের তিনজনেরই নীতির ভিত্তি স্বাধীনতার আদর্শ এবং আইনের সমতার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু তারপরও নিজেদের স্বপ্ন পূরণে কিছু কিছু কাজের জন্য তারা সমালোচিত হয়েছেন। মজার বিষয় হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান শহর ড্রেসডেনে বোমা হামলার জন্য চার্চিল চরমভাবে সমালোচিত। আর লিংকন সমালোচিত যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের সময় 'হাবিয়াস কর্পাসদের' অধিকার স্থগিত করার জন্য। সে জন্যই এ লেখক যুক্তি দেখান যে, একই মানদন্ডে বঙ্গবন্ধুকেও ইতিহাসের অন্যতম সেরা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে গণ্য করা উচিত। কারণ, তিনি সারা জীবন সফলতার সঙ্গে কাজ করে গেছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু জনগণ এবং বাঙালি জাতির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগও স্বীকার করেছিলেন। যদিও শক্তির পাশাপাশি তার দুর্বলতাও ছিল। ১৯৭২ সালে স্যার ডেভিড ফ্রস্ট বিবিসিতে এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, " আমার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো আমার মানুষের প্রতি ভালোবাসা। আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতাও হলো আমি তাদের খুব বেশি ভালোবাসি। "
রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু: তিনটি উদাহরণ
স্কুল জীবন থেকেই বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বের দক্ষতা ও সম্ভাবনা দেখাতে আরম্ভ করেছিলেন। তারপরও এক পর্যায়ে কঠোর পরিশ্রম এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাই তাকে একজন সত্যিকারের রাজনীতিবিদ হিসেবে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত নতুন দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক পদে নির্বাচিত করেছিল। অথচ সে সময় তিনি কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর এমন এক রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি এবং দক্ষতা যা বাংলাদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের জন্য ছিল নজির। বলা যায়, তিনি তাঁর সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮২ সালের সমুদ্র আইন কনভেনশন আসারও অনেক বছর আগে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জন্য 'টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট ১৯৭৪' প্রণয়ন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিরও পথপ্রদর্শক। তিনি বাংলাদেশের সেই পররাষ্ট্রনীতি স্থাপন করেছিলেন, যেখানে বলা আছে, "সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারো প্রতি বৈরীতা নয়”। অতএব, গবেষকদের বিশ্লেষণাত্মক মনকে উদ্দীপ্ত করার জন্য এ তিনটি উদাহরণই যথেষ্ট। যা বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনায়কত্বের অনন্য মহিমারই ইঙ্গিত বহন করে।
প্রথম ঘটনা: বঙ্গবন্ধু ছিলেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রথম দিককার বন্দিদের একজন। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার বিষয়ে শাসকগোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি বলেছিলেন:
আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে চাই। আমরা অন্য কোনো ভাষা জানি বা না জানি তা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা যদি মনে করি যে, নিজেদেরকে বাংলায় প্রকাশ করতে পারছি তাহলে ইংরেজি জানলেও আমরা সবসময় বাংলায় কথা বলব। যদি এটি অনুমোদন করা না হয়, তাহলে আমরা সংসদ থেকে বেরিয়ে যাব। কিন্তু এই সংসদকে অবশ্যই বাংলা ভাষাকে অনুমোদন দিতে হবে। আর এটাই আমাদের অবস্থান।
দ্বিতীয় ঘটনা: ১৯৭১ সালের ৭ মার্চকে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখা হয়। সেদিন বঙ্গবন্ধু তার জ্বালাময়ী ভাষণে বলেন:
...প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। ...মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। তবু এই দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। ... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
তৃতীয় ঘটনা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসের মাধ্যমে একটি তারবার্তা চট্টগ্রামে পাঠান। যেখানে তিনি শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতাই ঘোষণা করেননি, বরং ওই সময়ে রাজনীতির ইতিহাসে অতুলনীয় এক স্পষ্ট কৌশলগত নির্দেশনা দিয়ে যান। তার সেই কৌশলগত নির্দেশনা ছিল:
এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাই, যে যেখানে আছে, যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।
উপসংহার
বাঙালির কাছে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক শব্দ। দেশ-বিদেশের ভক্ত সমর্থকদের কাছে তিনি ছিলেন হিমালয়তুল্য। ১৯৭৪ সালে হাভানায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল কাস্ত্রো (১৯২৬-২০১৬) লৌহমানব বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাতের পরে যথার্থই মন্তব্য করেছেন, "আমি হিমালয় দেখিনি। কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় এই মানুষটি হিমালয় সমান। আর এভাবেই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।" তার কারিশমা, প্রতিভা এবং প্রজ্ঞা বঙ্গবন্ধুকে একটি নতুন জাতি, রাষ্ট্র, মুদ্রা, মানচিত্রসহ আমাদের পরিচয়ের স্বতন্ত্র প্রতীক লাল-সবুজ পতাকার জন্ম দিতে জনগণকে নেতৃত্ব দানে সক্ষম করেছিল। বিখ্যাত ঐতিহাসিক, পন্ডিত ও শিক্ষাবিদরা তাদের লেখা বই এবং প্রবন্ধেও বঙ্গবন্ধুকে অন্যতম দীপ্তিময় রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। উপর্যুক্ত আলোচনার বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, রিয়ালিযমকে টুল হিসেবে ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল্যায়নে আরো অধিক মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। আর এ বৈশিষ্ট্যসমূহের কার্যকর অনুসন্ধান একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে কোনো ব্যক্তির গুণগত যোগ্যতাকে প্রমাণ করে। তাই বক্ষ্যমান গবেষণায় রিয়ালিযমকে ব্যাখ্যামূলক টুল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে; যাতে বাংলাদেশি ও বিদেশি শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে গবেষকরা একইভাবে বঙ্গবন্ধুর চমকপ্রদ রাষ্ট্রনায়কত্বের বৈশিষ্ট্য থেকে উপকৃত হতে পারেন। এছাড়া, বিংশ শতাব্দীর একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর উত্থান, কৌশলগত ও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি, একটি রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়ার এবং সফলতার সাথে পথচলার জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোকিত পথ দেখাতে বাতিঘর হিসেবে কাজ করবে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন বাস্তববাদী, সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়ক, যিনি কেবল তাঁর নিজের জনগণকেই চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করেননি, একইসঙ্গে আকৃষ্ট করেছেন বিশ্ব বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, শিল্পী এবং শিক্ষাবিদদেরও। দেশ এবং জনগণের জন্য জীবনের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ বঙ্গবন্ধুকে একজন মহান রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিশ্ব দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। নিপীড়িতদের কাছে বঙ্গবন্ধু ছিলেন দীপ্ত বাতিঘর। আবার বাঙালি জাতির জন্য তিনি ছিলেন তাদের পিতা।
----------------------
লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
কমডোর সৈয়দ মিসবাহউদ্দিন আহমদ, (সি), এনইউপি, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, বিএন ১৪ জানুয়ারি ১৯৮৬ তারিখে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর নির্বাহী শাখায় যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমীতে ১৭তম বিএমএ লং কোর্সের সাথে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে উক্ত অফিসার পেশাগত মৌলিক এবং উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের নিমিত্ত তদানিন্তন ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মান নেভাল একাডেমীতে যোগদান করেন এবং প্রশিক্ষণ শেষে ০১ জুলাই ১৯৮৮ সালে অল রাউন্ডার মিডশিপম্যান হিসেবে কমিশন লাভ করেন। উক্ত অফিসার ১৯৯৫ সালে নৌবাহিনী জুনিয়র স্টাফ কোর্স এবং পাকিস্তান হতে ১৯৯৭ সালে কমিউনিকেশন এন্ড ইলেক্ট্রোনিক ওয়ারফেয়ার স্পেশয়ালাইজেশন কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি ২০০২ সালে মিরপুর সামরিক বাহিনী কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজ হতে স্টাফ কোর্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেভী ওয়ার কলেজ হতে ২০০৩ সালে ২য় স্টাফ কোর্সে শীর্ষস্থান লাভ করেন। তিনি ২০০৮ সালে এএফডব্লিউসি কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি বাংলাদেশ নৌ বাহিনী প্রতিষ্ঠানে কমান্ড, অপারেশন এবং স্টাফ হিসেবে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৫ সালে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন UNMIS এর দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ নৌ বাহিনীতে চাকুরীকালীন পেশাগত দক্ষতা, ত্যাগ এবং কর্তব্য নিষ্ঠার ফলস্বরুপ নৌ উৎকর্ষ পদক লাভ করেন। তিনি ২০১৬ সালে ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি বাংলাদেশ ইউনির্ভাসিটি অব প্রফেশনালস্ হতে ব্যাচেলর অব সোসাল স্টাডিজ এবং মাস্টার্স ইন মিলিটারী সায়েন্স এন্ড ডিফেন্স স্টাডিজ ডিগ্রী লাভ করেন এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পিএইচডি করছেন। তিনি বিভিন্ন প্রকাশনা এবং ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখা প্রকাশ করার জন্য সচেষ্ট। বর্তমানে উক্ত অফিসার প্রতিরক্ষা এ্যাটাশে হিসেবে ব্রাজিলে কর্মরত আছেন।
0 Comments
Post a Comment